বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:৫১ পূর্বাহ্ন

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

Reporter Name / ২৪৫ Time View
Update : বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

ড. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বাংলাদেশে পালিত একটি বিশেষ দিবস। প্রতিবছর বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বর দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ই সেম্বর পাকিস্তান হানাদারবাহিনি বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর সকল বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। বুদ্ধিজীবী হত্যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প‚র্ব পাকিস্তানে বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন ইতিহাসের নৃশংসতম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানি, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ এই সুপরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের শিকার হন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা ও মদদে একশ্রেণীর দালালরা এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে।

বুদ্ধিজীবীরা প‚র্ববাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজে বরাবরই ছিলেন তৎপর এবং তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণকে আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেন। এ কারণে প‚র্ববাংলার বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই ছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের বিরাগভাজন। বুদ্ধিজীবী হত্যা ¯পষ্টতই ছিল সামরিক জান্তার নীলনকশার বাস্তবায়ন, যে নীলনকশার লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়ায় পরিণত করা এবং জাতিকে মেধা শূণ্য করা ।

স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। তারা আরো মনে করেছিল যে, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে বসবাস করতে পারবে না। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গুত্ব করতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা এবং কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকান্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা,যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভ‚মিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। বর্বর পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লাশের ক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকেই তাঁদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন,পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ও নিউজ উইক-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।

২৫ মার্চ ১৯৭১ কলো রাতেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবীদের নিধনযজ্ঞ কার্যক্রম। পরিকল্পিতভাবে ১৪ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক বুদ্ধিজীবী নিধন করা হয়েছিল। তাই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এইদিনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেন। বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪) থেকে জানা যায়,২৩২ জন বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছেন। তবে তালিকায় অস¤পূর্ণতার কথা ওই গ্রন্থেই স্বীকার করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৮,মতান্তরে ২৯ তারিখে বেসরকারিভাবে গঠিত বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। এরপর “বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি” গঠিত হয়। এই কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেছিলেন,এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে। উল্লেখ্য,ওই কমিশনের আহবায়ক ছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান,যিনি নিখোঁজ হন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন ১৯৭১ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর। কিন্তু তার ঔ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। “আর একটা সপ্তাহ গেলেই ওরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সবাইকেই মেরে ফেলত- আল বদর বাহিনীর মাস্টার প্ল্যান” দৈনিক আজাদ ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর সেখানে লেখা হয়েছিল: পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সাহায্যকারী দলগুলির মধ্যে জামাতে ইসলামীর ভ‚মিকা ছিল সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্য। আল বদর বাহিনীর যে দুইজন জল্লাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন – চৌধুরী মাইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান। বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন ১৯৭১ প্রফেসর ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসইনের কর্তৃক প্রণিত একটি দলিল পায় বলে জানা যায়। বুদ্ধিজীবীর হত্যায় যারা ঘৃণ্য ভ‚মিকা রাখে তাদের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধাপরাধী পাকি অফিসার ব্রিগে. রাজা, ব্রিগে আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্ণেল তাজ, কর্ণেল তাহের, ভিসি প্রফেসর ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসইন, ডঃ মোহর আলী, আল বদরের এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিন এদের নেতৃত্ব দেয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। ১১ ডিসেম্বর থেকে আল-বদর বাহিনী ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে। জামাত দাবী করে যে, এ নিধনযজ্ঞে তাদের কোন অংশগ্রহণ ছিল না, পরবর্তীতে এগুলোর সাথে তাদের নাম লাগানো হয়েছে।

বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের অনেককেই যে “ইসলামী ছাত্র সংঘ”-এর পুরানা পল্টন (১৫ পুরানা পল্টন) অফিসে এবং জামাতের মোহাম্মদপুর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল,সেকথা ডিসেম্বরের পত্রিকা থেকে জানা যায়। বুদ্ধিজীবী হত্যামামলার নথিপত্রের কোনো হদিস নেই রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক কারণে ৬ বছর ধরে ঝুলে রয়েছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলাটি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২০০২ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার চ‚ড়ান্ত প্রস্তাবনা দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রহস্যজনক কারণে সে মামলা দায়েরের অনুমতি দেয়নি। পরে মামলার নথিটিও উধাও করে দিয়েছে তৎকালীন জোট সরকার। অভিযোগ উঠেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পরিকল্পিত ভাবে মামলাটিকে ধ্বংস করেছে। সিআইডি’র সূত্র জানিয়েছে তারা বেশ কয়েকবার এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছেন। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ দমন আইনে মামলা দায়েরের কোনো অনুমতি পাননি। তিনি জানান, ১৯৯৭ সালে দায়ের করা বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণ¥লয়ের অনুমতিক্রমে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। কীভাবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা দায়ের করা যায়, সে ব্যপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের লিখিত প্রস্তাবনা চেয়েছিল। প্রস্তাবনা দেওয়ার পর সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। স্বাধীনতার ২৫ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নম্বর ১৫)। ওই হত্যা মামলায় আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু। মামলাটি সিআইডিতে পাঠানোর পর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির তৎকালীন সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমানকে (বর্তমানে অবসরে)।

তিনি মামলার তদন্ত পর্যায়ে ১৯৯৮ সালের ১৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা দায়েরের জন্য অনুমতি চান। তদন্ত চলাকালে তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়স্বজনদের ৪০ জনের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক আইনে মামলাটি নতুন করে দায়েরের জন্য সিআইডিকে প্রস্ততি নেওয়ার নির্দেশ দেয়। সিআইডি সূত্র জানায়, ওই আইনে মামলা দায়ের করার জন্য রমনা থানার মামলাটিতে চ‚ড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে আন্তর্জাতক যুদ্ধাপরাধ আইনে অনুমতি চেয়ে পুরো প্রক্রিয়া জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২০০২ সালে পুর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনাও পাঠানো হয়। ওই প্রস্তাবনা বলা হয়, কলাবরেটর অ্যাক্ট বাতিল হয়ে যাওয়ায় প্রচলিত আইনে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় বিচার পাওয়ার সম্ভবনা কম। কিন্তু ১৯৭৩ সালের প্রণীত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে এর বিচার সম্ভব। এ আইনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধানও রয়েছে। তবে এই আইনটি কার্যকর করতে হলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে অধ্যাদেশ জারি করলেই ওই আইনে মামলা দায়ের সম্ভব। সূত্র জানায়, এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উপরন্ত মামলাটির কাগজপত্র কোথায় কী অবস্থায় আছে সে ব্যাপারেও কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে। এক পর্যায়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে থাকা কাগজপত্র সিআইডির তৎকালীন অ্যাডিশনাল আইজি নিয়ে যান। সে কাগজপত্রেরও কোনো হদিস নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগ মূর্হূর্তে হানাদারদের এদেশীয় দোসর আলবদর বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। রমনা থানায় দায়ের করা বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার বাদী ফরিদা বানু বর্ণনা দিয়েছেন সে হত্যাকান্ডের। তিনি এজাহারে বলেছেন, তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও মুহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঘাতকরা মুহসীন হল সংলগ্ন বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে হলের দিকে যায়। হলের সামনে তাকে পেয়ে দারোয়ান আবদুর রহিমের গামছা নিয়ে চোখ বেঁধে ইপিআরটিসির একটি মাইক্রোবাস যোগে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। ঘাতকরা অন্যান্য হাউস টিউটরের বাসায়ও যায়। এ সময় ওই হলের ছাত্র ছিলেন বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক ড.

সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। পরে তারা জানতে পারেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ড. মোঃ মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সিরাজুল হক ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ আরো অনেককে ধরে নিয়ে গেছে আলবদররা। শহীদ বুদ্ধিজীবী মো. মুর্তজার ও সিরাজুল হকের ছেলে এনামুল হক অপহরণকারীদের দুজনকে চিনতে পারেন। তারা হলেন চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। দুজনই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের মধ্যে আশরাফুজ্জামান তৎকালীন অবজারভার পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮ ডিসেম্বর ফরিদা বানু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ছেড়ে আজিমপুরে ভাড়া বাসায় চলে যান। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তিনি তার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ড. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ দেখতে পান। ৫ জানুয়ারি মিরপুরের বর্তমান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে গিয়ে তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদের গলিত লাশ পান। লুঙ্গি ও জামা দেখে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন তিনি। বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি চৌধুরী মাইনুদ্দীন লন্ডনে ও আশরাফুজ্জামান নিউইয়র্ক প্রবাসী। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনারও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যারা দৈহিক শ্রমের বদলে মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেন তারাই বুদ্ধিজীবী। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা হলো:

বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কন্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী।

পাকিস্তান নামক অগণতান্ত্রিক এবং অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই বাঙালিদের বা পূর্ব-পাকিস্তানীদের সাথে পশ্চিম-পাকিস্তানের রাষ্ট্র-যন্ত্র বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। তারা বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। এরই ফলশ্রæতিতে বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভ‚ত হতে থাকে এবং বাঙালিরা এই অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। এ সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকতেন সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা। তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক-ভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তা-বোধে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার স¤পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এজন্য শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানী বাহিনী বাছাই করে করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। এছাড়া যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন পাকিস্তানের পরাজয় যখন শুধু সময়ের ব্যাপার তখন বাঙালি জাতি যেন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে তাই তারা বাঙালি জাতিকে মেধা-শূন্য করে দেবার লক্ষ্যে তালিকা তৈরি করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এ প্রসঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে যে যুক্তিটি দেয়া হয়েছে তা প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিযুক্ত:-এটা অবধারিত হয়, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের রচনাবলীর মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে। একটি জাতিকে নির্বীজ করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া। ২৫ মার্চ রাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে, তারপর ধীরে ধীরে, শেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বর ১০ তারিখ হতে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুতগতিতে।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী।
২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথে একসাথেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানী সেনারা অপারেশন চলাকালীন সময়ে খুঁজে-খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫শে মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে, পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কয়েকদিন আগে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করে, যেখানে এই সব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ধারণা করা হয় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। কারণ স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তার স্বহস্তে লিখিত ডায়েরী পাওয়া যায় যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়।এছাড়া আইয়ুব শাসন আমলের তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের এক সাক্ষাৎকার হতে জানা যায় যে, ফরমান আলীর তালিকায় তার বন্ধু কবি সানাউল হকের নাম ছিল। আলতাফ গওহরের অনুরোধক্রমে রাও ফরমান আলি তার ডায়েরীর লিস্ট থেকে সানাউল হকের নাম কেটে দেন। এছাড়া আলবদরদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন বলে তার ডায়েরীতে একটি নোট পাওয়া যায়।
এছাড়া তার ডায়েরীতে হেইট ও ডুসপিক নামে দুজন মার্কিন নাগরিকের কথা পাওয়া যায়। এদের নামের পাশে ইউএসএ এবং ডিজিআইএস লেখা ছিল। এর মধ্যে হেইট ১৯৫৩ সাল থেকে সামরিক গোয়েন্দা-বাহিনীতে যুক্ত ছিল এবং ডুসপিক ছিল সিআইএ এজেন্ট। এ কারণে সন্দেহ করা হয়ে থাকে, পুরো ঘটনার পরিকল্পনায় সিআইএ’র ভ‚মিকা ছিল।

ডিসেম্বরের ৪ তারিখ হতে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক-সহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মত বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা হতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের উপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভ‚মিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।
এমনকি, আত্মসমর্পণ ও যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পরেও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তার সহযোগীদের গোলাগুলির অভিযোগ পাওয়া যায়। এমনই একটি ঘটনায়, ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখ স্বনামধন্য চলচ্চিত্র-নির্মাতা জহির রায়হান প্রাণ হারান। এর পেছনে সশস্ত্র বিহারীদের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রতি বছর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” হিসেবে পালন করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন বধ্যভ‚মি খোঁজার জন্য ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর থেকে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। সারা দেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভ‚মি শনাক্ত করতে পেরেছে তারা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন প্রকাশিত পত্রিকা, এ বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গ্রন্থ, এবং মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার এবং স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব বধ্যভ‚মি খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে। প্রত্যেক বধ্যভ‚মিতে ফলক স্থাপনের পরিকল্পনা হচ্ছে। অধিকাংশ জেলাতেই মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভ‚মিগুলো হয় রেলের নয়তো সড়ক ও জনপথের আওতাভুক্ত জায়গায়।দেশকে মেধাশূন্য করার পৈশাচিক পরিকল্পনা নেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভ‚মিকায় ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি । বাংলাদেশ সরকারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মহান স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত বধ্যভ‚মিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ নামের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করেছে, যাতে প্রথমে দেশের ১৭৬টি বধ্যভ‚মি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে ১২৯টি বধ্যভ‚মি সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এগুলো হলো— ঢাকা জেলায় আটটি, রাজবাড়ী জেলায় তিনটি, ফরিদপুরে চারটি, নরসিংদীতে চারটি, মুন্সীগঞ্জে পাঁচটি, টাঙ্গাইলে দুটি, শেরপুরে দুটি, কিশোরগঞ্জে এগারোটি, ময়মনসিংহে নয়টি, মানিকগঞ্জে একটি, শরীয়তপুরে একটি, গাজীপুরে একটি, জয়পুরহাটে পাঁচটি, নওগাঁয় সাতটি, রাজশাহীতে তিনটি, নাটোরে ছয়টি, পাবনায় একটি, বগুড়ায় চারটি, রংপুরে দুটি, লালমনিরহাটে একটি, গাইবান্ধায় নয়টি, পঞ্চগড়ে চারটি, ঠাকুরগাঁওয়ে চারটি, নীলফামারীতে ছয়টি, দিনাজপুরে একটি, চট্টগ্রামে এগারোটি, সুনামগঞ্জে দুটি, হবিগঞ্জে একটি, যশোরে তিনটি, ঝিনাইদহে দুটি, খুলনায় দুটি, পিরোজপুরে দুটি, বাগেরহাটে একটি ও ভোলায় একটি করে বধ্যভ‚মি রয়েছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এটি ঢাকার মীরপুরে অবস্থিত। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি মোস্তফা হালি কুদ্দুস। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তাদেরকে মিরপুর এলাকায় ফেলে রাখে। সেই সকল বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে সেই স্থানে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। এ সকল বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভ‚মিতে নাম জানা ও অজানা বুদ্ধিজীবীদের সম্মানে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। স্থপতি মো. জামী-আল সাফী ও ফরিদউদ্দিন আহমেদের নকশায় নির্মিত এ স্মৃতিসৌধ ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বাংলাদেশ ডাকবিভাগ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিটের সিরিজ বের করেছে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশটাকে সাময়িকভাবে অগ্রগতির পথ রদ্ধ করতে পারলেও বাস্তবিক পক্ষে আমরা আজ বহুদূর এগিয়েছি। অবাক সারা বিশ^। আমরা আরো এগিয়ে যাবো ।

লেখক : গবেষক, লেখক ও চেয়ারম্যান ,

নরসিংদী প্রেসিডেন্সি কলেজ ,

ব্রাহ্মন্দী,নরনিংদী । সেল : ০১৭১৭৩২৪৯৭৫


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল