শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩২ অপরাহ্ন

নরসিংদীতে দুই ইউপি সদস্যের দ্বন্ধ; ৪মাস ধরে বাড়ি ছাড়া শতাধিক নারী-পুরুষ

Reporter Name / ৬৩ Time View
Update : সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২২

মো. মোস্তফা খান, নরসিংদী :

আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমশ বদলে যাচ্ছে সবকিছু। তবে নরসিংদীর রায়পুরার চরাঞ্চলসহ আশপাশের কিছু এলাকায় যেন এখনো বিরাজ করছে প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার যুগ। এখানকার জীবনাচারের স্বাভাবিক চিত্রে পরিণত হওয়া টেঁটাযুদ্ধ, হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট প্রত্যক্ষ করলে মনে হবে আধুনিকতা বা সভ্যতা এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের মন-মগজে কোনো আঁচড়ই কাঁটতে পারেনি।

সম্প্রতি উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের গজারিয়াকান্দি গ্রামে সরজমিনে গিয়ে এসবের বাস্তবতার মিল খুজে পাওয়া যায়। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই ইউপি সদস্যের দ্বন্ধে দীর্ঘ প্রায় ৪ মাস ধরে নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র খেয়ে না খেয়ে দিনাতীপাত করছেন শতাধিক মানুষ। তাদের চিরচেনা বাসস্থানগুলো এখন ভুতুরে পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বসবাস করছে বিশাক্ত সাপ-বিচ্ছু-পোকামাকড়। এ যেন দেখার কেউ নেই।

স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ এলাকার মানুষজন তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণেও টেঁটা-বল্লম-ঢাল নিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এসব অঞ্চলে কখনো গোষ্ঠীগত, কখনো এলাকার প্রভাব প্রতিপত্তি, কখনো সীমানা বিরোধ নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে টেঁটাযুদ্ধে জড়িয়ে পরে শত শত গ্রামবাসী। প্রতি বছর গা শিউরানো মরণপণ এসব যুদ্ধের বলি হয় বেশ কিছু প্রাণ। প্রতিপক্ষের হামলা-মামলায় সর্বস্ব হারায় শত শত পরিবার। তবু তারা সর্বনাশা টেঁটাযুদ্ধ থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়ায় না। যারা নিহত হয়, তাদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে পাল্টা খুন আর মামলায় ক্ষতবিক্ষত হয় শান্তির জীবন। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে খুনীদের শাস্তি নিশ্চিত করণে এবং একইসঙ্গে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ৩/৪শত লোককে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
পরে মামলা সূত্রে এলাকায় পুলিশ নিয়ে মহড়া দেয় বাদীপক্ষের লোকজন। আসামি আর তাদের স্বজনরা গ্রেপ্তার ও পুলিশী হয়রানির ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সুযোগে বাদীপক্ষের লোকজন আসামিদের বাড়িঘর, গরু-ছাগল, নৌকা ও জমির ধানসহ অন্যান্য জিনিসপত্র লুটপাটসহ পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

স্থানীয়রা আরো জানান, গত ইউপি নির্বাচনে শ্রীনগর ইউনিয়নের ০৩নং ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন শাহ আলম মেম্বার ও হাজী আব্দুল খালেক। নির্বাচনে হাজী আব্দুল খালেক বিজয়ী হয়। এরই চাপা ক্ষোভে পরাজিত প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ায় কিছুদিন পর গত ১৩জুলাই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় উভয়পক্ষের লোকজন। এতে শাহআলম মেম্বারের সমর্থক মফিজ উদ্দিন নামে একজন টেটাবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। এরই জেরে বিজয়ী আব্দুল খালেকের লোকজনের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। এসময় ভাঙচুরকারীরা স্বাধিনতাযুদ্ধকালীন পাকবাহিনীর হামলাকেও হার মানায়। অর্ধ শতাধিক কাচা-পাকা স্থাপনাও মাটিতে গুড়িয়ে দেওয়া হয়। উক্ত ঘটনার পর থেকে আজ প্রায় ৪মাস ধরে এলাকা ছাড়া এসব বাড়ি-ঘরের শিশু-বৃদ্ধাসহ শতাধিক নারী-পুরুষ। তারা প্রতিপক্ষের ভয়ে এবং মামলার আসামী হওয়ায় এলাকায় প্রবেশ করতে না পেরে আশেপাশের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে দিনাতীপাত করছেন। তাদের চিরচেনা বসতবাড়িগুলো এখন ভুতুরে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রাণচাঞ্চল্য উঠোনে লম্বা লম্বা গাছপালা জন্ম নিয়েছে। দেখে মনে হবে দীর্ঘ বছরের পরিত্যক্ত বসতভিটা এসব।

এলাকা ছাড়া জাহার আলী, বাচ্চু মিয়া, শাহজাহান মিয়া, জিয়া মিয়া, সাজু মিয়া, সফরত মিয়া, হান্নান মিয়া, জমির মিয়াসহ আরো অনেকেই জানান, ঐদিনের সংঘর্ষে আমাদের অন্তত ২০ জন গুরুতর আহত হন। এর পর মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকা কিছুটা পুরুষ শূন্য হয়ে ওঠার পর প্রতিপক্ষের লোকেরা আমাদের ৯৬টি বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এতে প্রায় ৩০/৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এর পর থেকে আমরা অন্যত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছি এবং আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে অতিকস্টে দিনাতীপাত করছি।

ইউপি সদস্য হাজী আব্দুল খালেক বলেন, আমি ঝগড়ার সময় এলাকায় ছিলাম না, চিকিৎসার জন্য নরসিংদী ছিলাম। ঝগড়ার সাথে আমি জড়িত না, তবুও আমাকে প্রথম আসামী করেছে। এ মামলায় সাধারন নিরীহ মানুষকেও আসামী করা হয়েছে। আমাকে ভোট দেওয়ার কারনে আমার শতাধিক নারী-পুরুষ কয়েক মাস ধরে বাড়ি ছাড়া। অন্যের বাড়িতে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতীপাত করছে তারা। শাহআলম মেম্বার আমার সাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে পরাজয় হয়ে সে এসব কর্মকান্ড করেছে। এমতবস্থায় সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ স্থানীয় প্রশাসনের আশুহস্তক্ষেপ কামনা করছি।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ও পরাজিত ইউপি সদস্য শাহ আলম বলেন, সংঘর্ষের সাথে নির্বাচনের কোন সস্পৃক্ততা নেই। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খালেক মেম্বারের লোকজন মফিজ উদ্দিন নামে আমার এক লোককে হত্যা করেছে। হত্যার পর তারা নিজেরাই বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করে মালামাল নিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমি হত্যাকারীদের বিচারের দাবী জানাচ্ছি।

স্থানীয় শ্রীনগর ইউপি চেয়ারম্যান রিয়াজ মোর্শেদ খান রাসেল বলেন, আমাদের চরাঞ্চলের কালচারই এমন- সংঘর্ষের পর বিবাদীরা বাড়ি ছেড়ে দেয়। এসময় কালচার অনুযায়ী বিবাদীদের বাড়ীঘর ভাঙচুর-লুটপাট করে। তাদের মনোভাব এমন- আমাদের লোক মেরে ফেলেছে যারা, তারা বাড়ি আসতে পারবে না। তবে আমি কোন পক্ষের বা বিপক্ষের নই। আমি শান্তির পক্ষে। আমি চাই এলাকার মানুষ শান্তিতে থাকুক। এটা নির্বাচন পরবর্তি সহিংসতা নয়। চায়ের দোকানে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এটা ঘটেছে। খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসনসহ দ্রæত এলাকায় পৌছে থামানোর চেষ্ঠা করেছি। পরবির্ততেও একাধিকার ফয়সালার চেষ্ঠা করে পারিনি। এখন এমপি মহোদয়ের সাথে বসে আপসমিমাংসার চেষ্ঠা করবো।

এ ব্যাপারে রায়পুরা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আজিজুর রহমান বলেন, উভয় পক্ষের মামলা রয়েছে থানায়। চার্জসিটও হয়ে গেছে। এ অঞ্চলের কালচার অনুযায়ী বিবাদীদেরকে এলাকায় থাকতে দেয় না। যখন এলাকায় তারা ডুকতে চাই তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। শুনেছি যুগযুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছি এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শক্রমে সুন্দর পরিবেশের চেষ্ঠা করবো ইনশাআল্লাহ।

স্থানীয় সচেতন মহলের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানকার জনপ্রতিনিধিরাই এসব ঘটনার সৃষ্টি করেন। নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারা ঝগড়া-লড়াই জিইয়ে রাখেন। এসব জনপ্রতিনিধিরা সচেতন না হলে শুধু প্রশাসনের চেষ্টায় টেঁটাযুদ্ধ রোধ করা যাবে না। চরাঞ্চলের টেঁটাযুদ্ধ সামাজিকভাবে প্রতিরোধ ছাড়া শুধুমাত্র পুলিশ দ্বারা বন্ধ করা সম্ভব না। মূলত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতেই রয়েছে এখানকার টেঁটাযুদ্ধ সংস্কৃতির কলকাঠি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল