আরিফুর রহমান স্বপন, কুমিল্লা প্রতিনিধি:
রাজকীয় বিদায় ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রং-বেরঙের বেলুন দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে ঘোড়ার গাড়ি। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ফুলের তোরা। এলাকার সকল রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, সাবেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা তৈরি হয়ে এসেছেন মাদ্রাসা কমপ্লেক্সে। গলায় পুষ্প মাল্য, হাতে সম্মাননা স্মারক ও নানা ধরনের উপহার নিয়ে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি করে কর্মজীবনের শেষ কর্ম দিবসে রাজকীয় ভাবে এভাবেই বাড়ি ফিরে গেলেন এক মাদ্রাসা শিক্ষক।
এই বিশেষ আয়োজনটি করা হয়েছে কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভার ডুরিয়া বিষ্ণুপুর এলাকার আলহাজ্ব জুলফে আলী মোমেনা খাতুন মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের সহকারী শিক্ষক হাফেজ মাওলানা আবু তাহেরের জন্য। দীর্ঘ ২১ বছর আলহাজ্ব জুলফে আলী মোমেনা খাতুন মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শেষে আজ তার বিদায় নেয়ার পালা। অবসরসংক্রান্ত এই বিদায় বেলাটি স্মরণীয় করে রাখতে ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় শিক্ষককে দিলেন এই জমকালো রাজকীয় সংবর্ধনা।
রবিবার (৭ এপ্রিল) সকালে আলহাজ্ব জুলফে আলী মোমেনা খাতুন মাদ্রাসা কমপ্লেক্স হল রুমে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে মাদ্রাসার ২১ জন হাফেজকে মাথায় পাগড়ি প্রদান শেষে দুপুরে সাবেক শিক্ষার্থী, মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির নেতৃবৃন্দ ও এলাকাবাসী মিলে প্রথমে শিক্ষককে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। পরে সাবেক শিক্ষার্থীরা নগদ ৩০ হাজার টাকা এরপর আলহাজ্ব জুলফে আলী মোমেনা খাতুন মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে নগদ ১ লাখ টাকা হাদিয়া ও বিভিন্ন উপহারসামগ্রী দিয়ে সুসজ্জিত একটি ঘোড়ার গাড়িতে উঠিয়ে ওই শিক্ষককে নিজ বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয়। হাফেজ মাওলানা আবু তাহের লাকসাম পৌরসভার উত্তরকুল গ্রামের মৃত মৌলভী আলী আশ্রাফ খানের ছেলে।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, পৌরসভার ডুরিয়া বিষ্ণুপুর এলাকায় প্রায় দুই একর জায়গার মধ্যে আলহাজ্ব জুলফে আলী মোমেনা খাতুন মাদ্রাসা কমপ্লেক্স নামে ২০০৩ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইয়া গ্রুপের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৃত আলহাজ্ব মুখছেদ আলী। একই সালে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন হাফেজ মাওলানা আবু তাহের। তখন ছোট্ট একটি টিনের ছাউনির মাদ্রাসা ছিল সেটি। ওই সময় ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। বর্তমানে দুইটি কমপ্লেক্স ও মসজিদ, মক্তবসহ ওই মাদ্রাসায় প্রায় সাড়ে চারশত ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করছেন। একটানা ২১ বছর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে এখন তার বয়স ৭৫ বছর। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা শেষে বার্ধক্যের কারণে রবিবার তিনি অবসর নিলেন।
এদিকে সাবেক শিক্ষার্থীরা ও অভিভাবকবৃন্দ তার বিদায় বেলাটিকে স্মরণীয় করতে বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। শিক্ষক সম্মানে বিদায় বেলায় তাকে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি প্রস্তুত করে সেই গাড়িতে চড়িয়ে বাড়ি পৌঁছে দেন শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী।
এমন বিদায়ী সংবর্ধনা পেয়ে হাফেজ আবু তাহের আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, আমি যখন এখানে আসি মাদ্রাসাটি ছোট একটি টিনের ঘর ছিলো। আমি সামান্য একটি মাদুর বিছিয়ে থাকতাম। গত কয়েকসবছর পূর্বে সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘ভাইয়া গ্রুপের অর্থায়নে ও পরিচালনা কমিটির সহযোগিতায় বর্তমানে মাদ্রাসার জন্য দোতলা কমপ্লেক্স ভবন, কমপ্লেক্সের পিছনে একটি আধুনিক ভবন ও একটি সুন্দর মসজিদ করা হয়েছে। বর্তমানে ৪’শ শিক্ষার্থী মনোরম পরিবেশে পাঠদান করছে এ প্রতিষ্ঠানে। এখন আমার বয়স হয়ে যাওয়ায় আজ এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে বিদায় নিতে হচ্ছে। কিন্তু আমার মন চাইছে না বিদায় নিতে। এলাকার সকলে আমাকে অনেক সম্মান দেখিয়েছে। আল্লাহ তাদের সবাইকে ভালো রাখুক।
আলহাজ্ব জুলফে আলী মোমেনা খাতুন মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের সভাপতি হাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, আজকের দিনটি আমাদের জন্য বেদনার। কেননা আমরা আমাদের আত্মার আত্মীয়কে বিদায় দিচ্ছি। যিনি দীর্ঘ ২১ বছর আমাদেরকে দ্বিনি শিক্ষায় আলোকিত করেছে। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। সৃষ্টিকর্তা তাকে সুস্থ রাখুক ভালো রাখুক এটাই আমাদের কামনা।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রশিদ বলেন, হুজুর যখন আমাদের এখানে আসে তখন আমাদের এলাকার সন্তানদের তিনি ইসলাম শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে শতশত ছাত্র হাফেজ হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। আজ হুজুর চলে যাওয়ায় আমরা সবাই কষ্ট পাচ্ছি। এসময় উপস্থিত ছিলেন, আলহাজ্ব রফিকুল ইসলাম, পৌরসভার সাবেক মেয়র মফিজুর রহমান, আদম আলী, মাদ্রাসা শিক্ষক জহিরুল ইসলাম, মো: মোস্তফা, মিজানুর রহমান, সাবেক শিক্ষার্থী হাফেজ মাওলানা খোরশেদ আলম, হাফেজ মাওলানা শাহাদাত হোসেন, হাফেজ মাওলানা সালেহ আহমেদ আজাদ, হাফেজ মাওলানা শাহজালাল সাজু প্রমুখ।